গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিন কত হলে রক্ত দিতে হয়
প্রশ্নটি প্রতিটি মায়ের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।গর্ভকালীন সময়ে হিমোগ্লোবিন স্বাভাবিক মাত্রায় না থাকলে মা ও শিশুর জন্য বড় ঝুঁকি তৈরি হয়।চিকিৎসকরা সাধারণত নির্দিষ্ট মাত্রার নিচে নামলে রক্ত দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
তাই গর্ভবতী মায়েদের জানা উচিত, গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিন কত হলে রক্ত দিতে হয় এবং কীভাবে এটি স্বাভাবিক রাখা সম্ভব।এই লেখায় আমরা জানব হিমোগ্লোবিনের স্বাভাবিক মাত্রা, কখন রক্ত দেওয়া দরকার হয় এবং প্রতিরোধের কার্যকর উপায়।
সূচীপএঃ গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিন কত হলে রক্ত দিয়ে হয়
- গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিন কত হলে রক্ত দিতে হয়
- গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিনের স্বাভাবিক মাত্রা
- কখন রক্ত দেওয়া প্রয়োজন হয়
- হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়ার কারণ
- হিমোগ্লোবিন কমে গেলে মায়ের ঝুঁকি
- শিশুর জন্য ঝুঁকি
- হিমোগ্লোবিন কমার লক্ষণ
- হিমোগ্লোবিন স্বাভাবিক রাখার উপায়
- কখন রক্তের পাশাপাশি ওষুধ প্রয়োজন হয়
- গর্ভাবস্থায় নিয়মিত হিমোগ্লোবিন পরীক্ষা
- শেষ কথাঃগর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিন কত হলে হবে রক্ত দিতে
গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিন কত হলে রক্ত দিতে হয়
গর্ভাবস্থায় একজন মায়ের শরীরের সবচেয়ে বড় চাহিদা হলো সুস্থ রক্ত এবং পর্যাপ্ত হিমোগ্লোবিনের মাত্রা। হিমোগ্লোবিন মূলত রক্তের লোহিত কণিকায় থাকা একটি প্রোটিন, যা শরীরের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গে অক্সিজেন সরবরাহ করে। গর্ভকালীন সময়ে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা কমে যাওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার। তবে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা অতিরিক্ত কমে গেলে মা ও গর্ভস্থ শিশুর জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি হয়। এই কারণে চিকিৎসকরা নির্দিষ্ট পর্যায়ে এসে রক্ত দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। আজকের এই লেখায় আমরা বিস্তারিত আলোচনা করব, গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিন কত হলে রক্ত দিতে হয়, এর কারণ, ঝুঁকি এবং প্রতিরোধের উপায়।
গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিনের স্বাভাবিক মাত্রা
সাধারণ অবস্থায় একজন সুস্থ নারীর রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ ১২-১৬ গ্রাম/ডেসিলিটার হওয়া উচিত। কিন্তু গর্ভাবস্থায় স্বাভাবিক পরিবর্তনের কারণে এই মাত্রা কিছুটা কমে যেতে পারে। গবেষণা অনুযায়ী, গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিন যদি ১১ গ্রাম/ডেসিলিটার বা তার বেশি থাকে, তবে তা নিরাপদ ধরা হয়। তবে এর নিচে নামলে তা অ্যানিমিয়া বা রক্তশূন্যতার ইঙ্গিত দেয়। বিশেষ করে, যদি হিমোগ্লোবিন ৭ গ্রামের নিচে নেমে যায়, তবে মায়ের শরীরের অক্সিজেন সরবরাহে মারাত্মক ঘাটতি দেখা দেয় এবং তখন রক্ত দেওয়া অপরিহার্য হয়ে ওঠে। তাই গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিনের স্বাভাবিক মাত্রা বজায় রাখা মা ও শিশুর সুস্থতার জন্য অত্যন্ত জরুরি।
কখন রক্ত দেওয়া প্রয়োজন হয়
হিমোগ্লোবিনের মাত্রা যদি ৭ গ্রামের নিচে নেমে যায়, চিকিৎসক সাধারণত রক্ত দেওয়ার পরামর্শ দেন। কারণ এত কম হিমোগ্লোবিনে মা দুর্বল হয়ে পড়েন, মাথা ঘোরা, শ্বাসকষ্ট, অস্বাভাবিক ক্লান্তি ও শরীর ফুলে যাওয়ার মতো উপসর্গ দেখা দেয়। আবার হিমোগ্লোবিন ৫ গ্রামের নিচে নেমে গেলে মায়ের প্রাণনাশের ঝুঁকিও বেড়ে যায়। তাই চিকিৎসকরা পরিস্থিতি বিবেচনা করে রক্ত দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। অনেক সময় গর্ভবতী মায়ের যদি প্রসবের সময় রক্তক্ষরণ বেশি হয় এবং হিমোগ্লোবিন হঠাৎ কমে যায়, সেক্ষেত্রেও তাত্ক্ষণিক রক্ত দিতে হয়। তাই গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিন কত হলে রক্ত দিতে হয়—এ প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, সাধারণত ৭ গ্রামের নিচে গেলে রক্ত দেওয়া জরুরি হয়।
হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়ার কারণ
গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়ার মূল কারণ হলো রক্তের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়া এবং শরীরে লৌহের ঘাটতি। গর্ভাবস্থায় মায়ের রক্তের পরিমাণ প্রায় ৩০-৫০% বেড়ে যায়, ফলে রক্ত পাতলা হয়ে যায় এবং হিমোগ্লোবিনের ঘনত্ব কমে যায়। এছাড়াও, লৌহজাত খাবার কম খাওয়া, ভিটামিন বি১২ বা ফলিক এসিডের অভাব, পরজীবী সংক্রমণ, দীর্ঘদিনের রক্তপাত ইত্যাদির কারণে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা দ্রুত হ্রাস পেতে পারে। আবার অনেক মায়ের গর্ভাবস্থায় বমি বেশি হলে শরীরে পুষ্টির ঘাটতি তৈরি হয়, যা অ্যানিমিয়ার ঝুঁকি বাড়ায়। তাই গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়ার কারণগুলো ভালোভাবে বোঝা জরুরি।
হিমোগ্লোবিন কমে গেলে মায়ের ঝুঁকি
হিমোগ্লোবিন অতিরিক্ত কমে গেলে গর্ভবতী মা নানা জটিলতার মুখোমুখি হন। এর ফলে শরীরে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেয়, যা হৃদস্পন্দন অস্বাভাবিক করে তুলতে পারে। মায়ের মধ্যে দুর্বলতা, মাথা ঘোরা, শ্বাসকষ্ট, বুক ধড়ফড় করা, হাত-পা ফুলে যাওয়া এমনকি হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মতো উপসর্গ দেখা দেয়। তাছাড়া, প্রসবকালীন সময়ে রক্তক্ষরণের পরিমাণ বেশি হলে মায়ের মৃত্যু ঝুঁকিও বেড়ে যায়। এজন্য ডাক্তাররা সবসময় সতর্কভাবে গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিনের মাত্রা পর্যবেক্ষণ করার পরামর্শ দেন।
শিশুর জন্য ঝুঁকি
শুধু মা নন, হিমোগ্লোবিন কমে গেলে গর্ভস্থ শিশুও ঝুঁকির মুখে পড়ে। শিশুর পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহে ঘাটতি হলে জন্মগত জটিলতা, কম ওজনের শিশু জন্মানো, অপরিণত প্রসব, এমনকি শিশুর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। আবার অনেক সময় নবজাতক খুব দুর্বল হয়ে জন্ম নেয় এবং জন্মের পর নানা স্বাস্থ্য সমস্যায় আক্রান্ত হয়। তাই হিমোগ্লোবিন স্বাভাবিক রাখাটা শুধু মায়ের জন্য নয়, বরং শিশুর সুস্থতার জন্যও অত্যন্ত জরুরি। এ কারণেই চিকিৎসকরা ৭ গ্রামের নিচে হিমোগ্লোবিন নেমে গেলে রক্ত দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
হিমোগ্লোবিন কমার লক্ষণ
গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিন কমে গেলে কিছু সাধারণ লক্ষণ দেখা দেয়। যেমন—অতিরিক্ত ক্লান্তি, মাথা ঘোরা, শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া, ঠোঁট ও চোখের পাতা ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া, হাত-পায়ে দুর্বলতা, চুল পড়া, এমনকি সামান্য কাজেও অস্বাভাবিক ঘাম হওয়া। অনেক সময় রাতে ঘুমের মধ্যে শ্বাসকষ্ট বেড়ে যেতে পারে। এসব উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত ডাক্তারকে জানানো উচিত, কারণ এগুলো গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়ার লক্ষণ হতে পারে। প্রয়োজনে রক্ত পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হবে এবং চিকিৎসকের পরামর্শে ব্যবস্থা নিতে হবে।
হিমোগ্লোবিন স্বাভাবিক রাখার উপায়
গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিন স্বাভাবিক রাখতে হলে পুষ্টিকর খাদ্যাভ্যাস সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। লৌহসমৃদ্ধ খাবার যেমন কলিজা, লাল মাংস, ডাল, শাকসবজি, খেজুর, ডিম, পালং শাক, মটরশুটি, বিটরুট ইত্যাদি নিয়মিত খাওয়া উচিত। পাশাপাশি ভিটামিন সি যুক্ত খাবার যেমন—লেবু, কমলা, টমেটো ইত্যাদি খেলে লৌহ শোষণ সহজ হয়। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী আয়রন ট্যাবলেট, ফলিক এসিড এবং ভিটামিন বি১২ খাওয়া দরকার। পর্যাপ্ত বিশ্রাম, হালকা ব্যায়াম এবং নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করলেও গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিন স্বাভাবিক রাখা সম্ভব।
কখন রক্তের পাশাপাশি ওষুধ প্রয়োজন হয়
সব সময় রক্ত দেওয়া একমাত্র সমাধান নয়। অনেক সময় চিকিৎসক রক্তের পাশাপাশি আয়রন ইনজেকশন বা ওষুধ দিয়ে থাকেন, বিশেষ করে যদি হিমোগ্লোবিন মাঝারি পর্যায়ে কমে থাকে। এতে ধীরে ধীরে রক্তের গুণগত মান বৃদ্ধি পায় এবং ভবিষ্যতে পুনরায় হিমোগ্লোবিন কমার ঝুঁকি হ্রাস পায়। তবে যদি হিমোগ্লোবিন ৫-৬ গ্রামের নিচে নেমে যায়, তখন দ্রুত রক্ত দেওয়াই একমাত্র উপায়। তাই গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিন কমে গেলে চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী রক্ত ও ওষুধ দুটোই প্রয়োজন হতে পারে।
গর্ভাবস্থায় নিয়মিত হিমোগ্লোবিন পরীক্ষা
প্রসবকালীন নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নিয়মিত হিমোগ্লোবিন পরীক্ষা অত্যন্ত জরুরি। অনেক মায়েরা বাহ্যিকভাবে সুস্থ দেখালেও তাদের ভেতরে হিমোগ্লোবিনের ঘাটতি থাকতে পারে। তাই ডাক্তাররা প্রতি মাসে হিমোগ্লোবিন পরীক্ষা করার পরামর্শ দেন। এর ফলে আগেভাগেই সমস্যা ধরা পড়ে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া যায়। যদি দেখা যায় হিমোগ্লোবিনের মাত্রা দ্রুত কমছে, তবে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয়। তাই গর্ভাবস্থায় নিয়মিত হিমোগ্লোবিন পরীক্ষা করা মা ও শিশুর জন্য সুরক্ষার ঢাল।
শেষ কথাঃগর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিন কত হলে হবে রক্ত দিতে
গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ১১ গ্রামের বেশি থাকাই সবচেয়ে নিরাপদ। তবে ৭ গ্রামের নিচে নেমে গেলে রক্ত দেওয়া প্রয়োজন হয় এবং ৫ গ্রামের নিচে গেলে পরিস্থিতি মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। তাই মায়েদের সবসময় পুষ্টিকর খাবার খাওয়া, নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা এবং ডাক্তারদের পরামর্শ মেনে চলা উচিত। মনে রাখতে হবে, সুস্থ মা মানেই সুস্থ শিশু। তাই গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিন স্বাভাবিক রাখা প্রতিটি মায়ের প্রথম কর্তব্য।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url